বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশ্য বিরোধে ঢাকায় রুশ এবং মার্কিন দূতাবাস?

বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশ্য বিরোধে ঢাকায় রুশ এবং মার্কিন দূতাবাস?

সম্প্রতি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে ঢাকার রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি দিয়েছে, যাতে পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার’ অভিযোগ তোলা হয়েছে।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিককে ইঙ্গিত করে রাশিয়ার মতো আরেকটি দেশের দূতাবাস থেকে এধরণের বিবৃতি এক নজিরবিহীন ঘটনা।

রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, “কিছু দেশ, যারা নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে দাবি করে, তারা অন্য সাবভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করেনা, এমনকি ব্ল্যাকমেইলও করে।”

রুশ দূতাবাস থেকে এই বিবৃতিটি মঙ্গলবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, তারা কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।

বাংলাদেশকে নিয়ে দুটি দূতাবাসের মধ্যে এরকম কূটনৈতিক বচসার ঘটনার অতীতে দেখা যায়নি।

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, সে সময় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস এই বিবৃতি দিল।

রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে আমেরিকার নাম উল্লেখ না করলেও সেখানে যে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা বেশ স্পষ্ট। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ““যেসব দেশ নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র হিসেবে পরিচয় দেয় এসব ঘটনা তাদের আধিপত্য বাদের আকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুটে উঠে। জাতিসংঘের সদস্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা শুধু হস্তক্ষেপ-ই করেনা, তারা নির্লজ্জভাবে ব্ল্যাক-মেইল করছে।”

এর ফলে অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

“যেসব দেশে নিজেদের বিশ্বের শাসক মনে করে তারা যদি কোন দেশকে পছন্দ না করে তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ছলে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।”

রুশ দূতাবাস বলেছে, "অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য রাশিয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

রাশিয়ার চাওয়া কী?

যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে তাদের পাল্টা রাশিয়া বিবৃতিতে যেভাবে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন দিচ্ছে, সেটি নজিরবিহীন।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের সমালোচনা করলেও চীন, ভারত এবং রাশিয়া সেটি করেনি। এমন অবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে।

কিছু দেশ সরাসরি আমেরিকা এবং ইউরোপের সাথে আছে। ভারত, চীনসহ আরো কিছু দেশ আমেরিকার বিপক্ষে না গেলেও রাশিয়ার সাথে তারা ভালো সম্পর্ক বজায় চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাশিয়া যেভাবে প্রকাশ্যে আমেরিকা বিরোধী অবস্থান নিয়েছে তার দুটো কারণ থাকতে পারে।


একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক। বাংলাদেশে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়া। ফলে এখানে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক।

“আমরা যদি রাশিয়ার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করি, রাশিয়াও তো এক ধরণের অথরিটারিয়ান (কর্তৃত্ববাদী) রাষ্ট্রই। যার ফলে অথরিটারিয়ান রেজিমদের ব্যাপারে এবং আমরা যদি গ্লোবালিও দেখি তাদের সমর্থন দেবার ব্যাপারে রাশিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে,” বলেন মি. খান।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া  এবংইউরোপের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য বজায় রেখেছে।

কিন্তু এই ভারসাম্য কতদিন বজায় থাকবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এবং স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক রাজিয়া সুলতানা বলছেন, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে যেসব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে রাশিয়ান দূতাবাস তাদের বিবৃতির মাধ্যমে সেটির প্রশংসা করেছে।

“নিউট্রাল ফরেন পলিসির (নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি) ব্যাপারে বাংলাদেশ সময়ে সময়ে অবস্থান প্রকাশ করেছে,” বলেন রাজিয়া সুলতানা। বিশ্ব রাজনীতিতে দেখা যায়, আমেরিকা যেখানে প্রভাব খাটাতে চায় তার বিপরীতে রাশিয়া পাল্টা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে এখন সেরকম অবস্থান তৈরি হয়েছে।

এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঝুঁকিও তৈরি করছে বলে মনে করেন অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান। তিনি বলছেন, শুধু বিশ্ব রাজনীতি নয়, এমন পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও দায়ী।

“সবচেয়ে দু:খজনক হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো – যারা ক্ষমতায় আছে কিংবা যারা ক্ষমতায় যেতে চায় – তাদের প্রবণতা হচ্ছে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর আনুকূল্য পাওয়া।”

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে অন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরোধ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার উপর অনেকটাই নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটির প্রভাব আরো বাড়বে কি না।