বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। মানবাধিকার এমন একটি সর্বজনীন ধারণা যা প্রতিটি মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যক্তি সমান অধিকার এবং স্বাধীনতার দাবিদার। বাংলাদেশও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে এই নীতিমালা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
বাংলাদেশে সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের জন্য কাজ করা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা (ডিএসএ) আইন সহ সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ বাকস্বাধীনতার ওপর গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো একাধিকবার এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগকে সংকুচিত করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাসই করছে না, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি বড় সমস্যা। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক সহিংসতার মতো ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, ধর্ষণ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া ধীর এবং অপরাধীরা প্রায়শই শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হল আইনের শাসনের অভাব। পুলিশ, র্যাব এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, বিচারব্যবস্থার ধীরগতি এবং অস্বচ্ছতা নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বড় বাধা। মামলা দীর্ঘায়িত হওয়া, দুর্নীতি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি করছে।রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের ঘটনা বাংলাদেশে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, সহিংসতা এবং অন্যায় আটকাদেশ মানবাধিকারের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে এবং এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক না কেন, সঠিক নীতি এবং দায়বদ্ধ নেতৃত্বের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রতিরোধ এবং দেশের জন্য একটি নিরাপদ ও মানবিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আজই আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।